প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে। আর সেই প্রযুক্তির সাহয্যে মানব সভ্যতা প্রতিদিনই এগিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। আমরা প্রতিদিনই ব্যবহার করছি নতুন নতুন প্রযুক্তি। তবু প্রযুক্তি কি এবং কীভাবে কাজ করে এই চিন্তা করতে গেলে মাথা বেশি সময় কাজ করে না। যারা প্রযুক্তি দুনিয়ার সাথে জড়িত নয়, তাদের কাছে প্রযুক্তি ব্যাপারটাই বিস্ময়কর। সাধারণ একটা ডেক্সটপ কম্পিউটারের কথা চিন্তা করতে গেলেই যেখানে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, সেখানে সুপার কম্পিটারের মত উচ্চ গতিশক্তিসম্পন্ন কোন কিছুর কথা চিন্তা করতে গেলে সাধারণ মানুষের বিস্ময়ও সীমা ছাড়ায়। এগুলো বোঝা যদিও সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব একটা সহজ নয়, তবে কৌতুহল তো দমিয়ে রাখা কঠিন।
গত ১০ জুন ২০১৮ তে সিএনএন নিউজের একটি রিপোর্ট পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আবিষ্কৃত নতুন সুপার কম্পিউটার সম্পর্কে কিছু বিস্ময়কর আর মজার তথ্য জানা যায়। রিপোর্টটিতে, পাঠকদেরকে খুব সহজভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, নতুন সুপার কম্পিউটারের গতি আর ক্ষমতার সাথে।
সিএনএন এ প্রকাশিত সে রিপোর্টে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞরা ডেভেলপ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন কম্পিউটার। তারা সেই কম্পিউটারের নাম দিয়েছে, “সামিট”। তারা বলছে, সামিটের গতি একটি ছুটন্ত বুলেটের থেকেও বেশি।
গত পাঁচ বছর ধরে সুপার কম্পিউটার তৈরির ক্ষেত্রে চীনের থেকে পিছিয়ে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন “সামিট” নামক সুপার কম্পিউটার তৈরির ফলে আবারও এ ক্ষেত্রে তাদের শীর্ষস্থানটি ফিরে পেয়েছে। “সামিট” নামক সুপার কম্পিউটার কতটা দ্রুতগতির কল্পনা করতে পারবেন? পারার কথা নয় অবশ্য।
সামিট, সুপার কম্পিউটার, আমেরিকা, চীন
যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির যে বিশেষজ্ঞরা এই সুপার কম্পিউটারটি ডেভেলপ করেছে তাদের মতে, প্রতি সেকেন্ডে সামিট ২০০ কোয়াড্রিলিয়নেরও বেশি হিসেব করে দিতে পারে।
২০০ কোয়াড্রিলিয়ন মানে কত, তা বুঝতে পারছেন না, তাইতো? সমস্যা নেই। ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির মিডিয়া ম্যানেজার, মরগ্যান ম্যাককর্কলি, সাধারণের জন্য সামিট এর গতিক্ষমতাকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
তার মতে, যদি একজন মানুষ প্রতি সেকেন্ডেও একটি হিসাব করে, ২০০ কোয়াড্রিলিয়ন হিসাব মিলাতে তার সময় লাগবে ৬.৩ বিলিয়ন বছর। আবার, বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি করে হিসাব সম্পূর্ণ করে, তবে এই পরিমাণ হিসাব করতে পুরো পৃথিবীর মানুষের সময় লাগবে ৩০৫ দিন। অথাৎ, পুরো পৃথিবীর মানুষ ৩০৫ দিনে যে পরিমাণ ক্যালকুলেশন করতে পারবে সামিট সেটা করে দিবে মাত্র ১ সেকেন্ডে। ভাবা যায়?
গবেষকরা সামিট নামক সুপার কম্পিউটারটিতে এক ঘন্টায় যে সমস্যার সমাধান করতে পারবে একটি সাধারণ ডেক্সটপ কম্পিউটারে তা করতে সময় লাগবে কত জানেন? ৩০ বছর!
যে কম্পিউটারের ক্ষমতা এত অবিশ্বাস্য, তার দামও যে অবিশ্বাস্যরকম হবে সেটা কল্পনা করা খুব একটা কঠিন নয়। সামিট-নামক সুপার কম্পিউটারটির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ২০০ মিলিয়ন ডলার!
ক্ষমতার মত, সামিটের আকৃতিটাও বিশাল। মেঝেতে ৫৬০০ স্কয়ার ফিট জায়গা দরকার হবে এ সুপার কম্পিউটারটি রাখার জন্য। অন্যভাবে বলা যায়, প্রায় দু’টি টেনিস কোর্টের সমান জায়গা দখল করবে সামিট।
সামিট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে যে পরিমাণ ফাইবার অপটিক ক্যাবল তা যদি একসাথে করা হয়, তবে তা লম্বায় ১৮৫ মাইলের সমান হবে।
সামিট, সুপার কম্পিউটার, আমেরিকা, চীন
এই সুপার কম্পিউটারটির ওজন ৩৪০ টনের সমান। সিএনএন নিউজ এর ওজন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মজার একটি উদাহরণ দিয়েছে, সামিটের ওজন প্রায় ৮৫ টি আফ্রিকান হাতির ওজনের সমান হবে।
আমেরিকার জন্য এ কম্পিউটার একধরণের জয়ের বার্তা বয়ে এনেছে। গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানে আমেরিকার নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল চীন। একারণে, ২০১৬ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি এবং ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি, আমেরিকার সুপার কম্পিউটিংয়ের উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার সুপার কম্পিউটরের উন্নয়নে প্রযুক্তি খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। তাই চীনের সাথে টক্কর দিতে যুক্তরাষ্ট্রও এ খাতে তাদের বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ায়।
২০১৭ সালে চায়নার ‘পেটাফ্লপস্’ নামক সুপারকম্পিউটারটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন কম্পিউটারের খেতাব অর্জন করেছিল। চীনের পেটাফ্লপস্ সে সময় আমেরিকার ওক রিজ ল্যাবরেটরির ‘টাইটান’ নামক সুপার কম্পিটারের থেকে আট গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এ বছর ওক রিজ ল্যাবরেটরি, সামিট নামের যে সুপার কম্পিউটারটির উন্নয়নে কাজ করেছে, সেটা পেটাফ্লপস্ এর থেকে দুই গুণ বেশি শক্তিশালী বলে বিশেষজ্ঞরা দাবী করছেন।
সামিটকে অবশ্য এখনো অফিশিয়ালি বিশ্বের সবথেকে দ্রুতগতির কম্পিউটার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কয়েক সপ্তাহ পরে, TOP 500’s mid-year report প্রকাশিত হলে অফিশিয়ালি জানা যাবে সামিট সত্যি সত্যিই বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার কিনা। এ রিপোর্টিতে গবেষকরা প্রতি দুই বছর পর পর বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন ৫০০ কম্পিউটারের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। যদি এ মাসে চীন নতুন কোন তেলেসমাতি না দেখায়, তবে সুপার কম্পিউটারের এ তালিকায় এবার শীর্ষস্থানটি পেতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সামিট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, জোতির্বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নয়নে কাজে লাগানো যাবে বলে এর গবেষকরা দাবী করেছেন। সুতরাং রোবট তৈরির প্রযুক্তিতে, নতুন নতুন গ্রহ-উপগ্রহের আবিষ্কারে এবং কঠিন সব রোগের প্রতিকার-প্রতিরোধে বিশ্ব আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে এই সুপার কম্পিউটারের আবিষ্কারের ফলে- এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়।
0 Comments